সুদীপ সান্যালের কাব্যগ্রন্থ ‘স্ফিংক্স ও অচেনা অর্কিডেরা’ নিয়ে কিছু কথা

কবিতার নিকটে উপনীত হওয়া বেশ কঠিন একটি কাজ। নতুন নির্মাণের ভাষায় উপনীত হওয়া আরও কঠিন। কিন্তু তাতে যদি থাকে আত্মঅন্বেষণ, বাস্তবতাকে প্রশ্রয় দিয়ে অনুপস্থিত বাস্তবতার স্বপ্নময় রূপায়ণ; তবে ঐ কাব্যভাষায় পাঠকের সমর্পণ ছাড়া আর গতি থাকে না। স্বরকে ভাষায় আর সে ভাষাকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে গেছেন সুদীপ। এখানেই তার স্বতন্ত্রতা। অজস্র লিখিত কবিতায় ব্যবহৃত ভাষা যেখানে অনুপস্থিত, ভাষার পরম রূপায়ণে তাই পাঠক পান ভিন্ন স্বাদের কবিতা, কবিকণ্ঠ হয়ে ওঠে স্বতন্ত্র একটি স্বর।

সুদীপের কবিতায় অন্যসবকিছুর সাথে যা দৃশ্যমান তা হোল কবিতার শরীরে শরীরে চোরাবালি আর অন্ধগলি তৈরির শৈল্পিক প্রয়াস। যেখানে পাঠকদের জন্য এক স্বাপ্নিক বিহ্বলতা রচিত হয়। পাঠকের নিরন্তর খোঁজ চলে সেখানে- শাশ্বতের খোঁজ। আধুনিক কবিদের জন্য আকাশ যেন ভেঙে পড়া ছাদ, জীবন মানেই কাতরতা, বন্দীত্ব আর এই জগৎ যেন যন্ত্রণার ছায়াচিত্র। ব্যক্তি এখন সর্বার্থে মুক্ত। ঈশ্বর, প্রকৃতি, সমাজ আর সৌন্দর্যের পরম ডাককেও সে আর এখন গ্রাহ্য করে না। অবশ্য এই মুক্তি এক জেলজীবনও বটে। তবে সুদীপ তার কবিতায় এই বন্দীদশাকে অগ্রাহ্য করেছেন। তার কবিতায় অবধারিত ভাবেই উঠে এসেছে সমাজ, তাকে আন্দোলিত করেছে বর্ষার সুমন্দ্রিত ধারা- হেমন্ত বিলাপ, অধুনা প্রযুক্তির জি পি এস, গুগুল, উইকি, চিরায়ত প্রেম, কান্না, প্রবাসের আখ্যান, বৃদ্ধাশ্রমের বিধূরতা আর অচেনা অর্কিড।

ঝরঝরে আর টানটান বাক্যে রচিত কবিতা গুলো মোহাবিষ্ট করে রাখে। সুদীপ তার লেখার লক্ষ্য জানেন, metaphor অথবা simile-তে ক্লিশের ব্যবহার বর্জন করেছেন, বর্জিত হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত ভাবালুতা। এখন বাকী রইলো তার কবিতার সাথে পাঠকের ‘যোগাযোগ’। অর্থাৎ কবিতাগুলো কী বোঝাতে চাইলো- এই আপাত বিরোধপূর্ণ প্রশ্ন। কবিতা কবির কাছে অর্থময় হয়ে উঠেছে কিন্তু পাঠকের কাছে তা কী বার্তা দিয়ে গেল সেই চির অমিমাংসিত প্রশ্নের জবাব। কবিতা পাঠে পাঠকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ অবশ্যই জরুরী। সুদীপের নির্মিত সম্পূর্ণ মৌলিক একটি কাব্যভাষার বহুমাত্রিক বর্ণিলতায়, তার অন্ধবিন্দুর বিমূঢ়তায় পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করবেন বলেই আমার বিশ্বাস। অবশ্য তার জন্য সুদীপের কবিতা পাঠের কোন বিকল্প নেই।

এবার একটু অন্যকথা। কবি সুদীপ দীর্ঘদিন ধরেই প্রবাসী। পেশায় একজন সফটওয়্যার সিনিয়র আর্কিটেক্ট। কবিতা গুলোতে বেশ কিছু জায়গায় ইংরেজী শব্দের ব্যবহার রয়েছে। এ ব্যবহার দোষের কিছু নয়। অধুনা এর প্রয়োগ হরহামেশাই হচ্ছে। তবে শব্দগুলোর এহেন প্রয়োগ আরো একটু পরিমিতির দাবি রাখে বলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি।

এই তো। সুদীপের কাব্যগ্রন্থ ‘স্ফিংকস ও অচেনা অর্কিডেরা’ আরো বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে, যা অন্যান্য বিদগ্ধ পাঠক, সমালোচক এবং কবিগণ ভবিষ্যতে অবশ্যই করবেন। ব্যক্তিগত সময় স্বল্পতা আর দ্রুত একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া প্রদানের লোভ সংবরণ করতে না পেরেই আমার এই ক্ষুদ্র একটি বার্তা। আশা করি কবি সুদীপ সহ বন্ধুরা তা মেনে নেবেন।
***

সুদীপ সান্যালের কিছু কবিতা-

১.

হাঁটু জলে বন্যা হলে মেয়েটি
*

হাঁটু জলে বন্যা হলে মেয়েটি মোড়ে গিয়ে দাঁড়ায়
ছোট্ট বাজার, এক-থলি ভরার মতো
পাঁচ টাকার কয়েন ভারী হয়ে আসে
একটা খোকা-রোদের বিকেল খুলে যায়
থমকে যায়
গোবরে লেপে থাকা দালান--
ইস্কাবনের মতো ছোটো বোন কাঁখে নিয়ে মজুর খাটে মা--

মেয়ের কাঠের কাজ ভালো লাগে
পিঠের ঘাম গড়ানোর মধ্যে যৌন-পরিশ্রম লুকোনো সে জানে
ধীর পায়ে পিঠে পিঠ ঘেঁষে বসে
ওয়াদা করে একছুটে ভুবনডাঙা পেরিয়ে যাওয়ার
আরও তিনমাস ঘরছাড়া বাপ
দালাল-দলিল-বাঁধা অনুসন্ধান চালায়

২.

খসে পড়া মুখোশের মিমিক্রি
*

এক প্যাস্টেল গ্রামীন গুঁড়ো চাঁদকে ঘিরে এত মাদল -

উঁচু জল নেবে গেছে ভেতরের মেঘে
গলে গেছে প্যাস্টেলে গুলে যাওয়া দুধ
এখনো পারি নি মৃদু কোন্দল প্রশমন
নাট্যশালার ফটকের বাইরে ঝুলে আছে মুখোশ
খসে পড়ছে মিমিক্রি,
- সমকক্ষ হত্তয়ার প্রচেষ্টাগুলো

আগুন মেকাপ নিয়ে হতাশায় কাঁপছে খসে পড়া মুখোশ
তার নাভির থেকে চক্রবায় উষ্মা ছিন্ন করছে শিকড় - প্রতিদিন
সমস্ত কোপানো শোচ একে অপরের দিকে হাত বাড়িয়ে -
দৃশ্যত: এগুলো অভিনয় করে দু-পয়সা ঘরে তোলে
- সামাজিক স্টেটাস

হিমেল কণা চলে আসছে ভ্যালির কাছাকাছি
শীত আসছে জলীয়,
ঘুমন্ত মুখোশ খসে পড়ে শেখাচ্ছে
অভিকেন্দ্রীয়
অনন্ত স্পর্শক
অ্যাসিম্পটোট
আর মৃত মিমিক্রি

৩.

স্তন্যপায়ী
*

সুধাপানের অভ্যাসে বেড়ে উঠলেও
চিবিয়ে প্রমাণ করলে শ্রেষ্ঠত্ব

৪.

তুমি পোষ মানোনি কোনোদিন
*

জেব্রার খোলস ছেড়ে পেভমেন্টে উঠে এসে দাঁড়াও এবার
তুমি পোষ মানো নি কোনদিন -
তোমার অ্যানাটমি ঘিরে কৌতূহলী ইতিহাস
বিপজ্জনক হয়ে ওঠবার আগে
ব্যাখ্যা করো ভ্রমনকাহিনীসমূহ

গল্পের প্লটে চেটেপুটে স্নিগ্ধ করে রেখেছো মিড-ওয়েস্ট
ডালাসের শীত ভীষণভাবে পড়েছে এবার -
খাদ্য তালিকায় স্মোকড মিট কাঁচা সব্জি কিছু
বিশেষণে তোমাকে ভাঙ্গতে দেখেছি অহরহ

রুপোলি কয়েন থেকে খিদে বাড়ছে
গৌণ শান্তির মত জ্বালা নিয়ে
উদ্যম গতি নিয়ে
দূরে যাচ্ছ, অথচ বীজশূন্য হয়ে ফিরে আসছো বারবার

আঘাতে বৃষ্টি পড়েছে
কাব্যের কষ, মিলিয়ে যাচ্ছে ঠোঁটে বেঁয়ে
তাতে জ্যোত্স্না মিশছে

শীতঘুমের মত অন্তর্গত অবচেতন নেই তোমার
তাতে তো আসে যায় না কিছু -
নিটোল স্নানের মত ভেজা ভেজা মুখোশ ছেড়ে
ক্র্যনবেরি রঙের ব্যথা ভুলতে ছুটে যাচ্ছো
কুহেলী কাটিয়ে -
বাষ্পের ভাপে ক্রমশঃ শিথিল হচ্ছে অক্রম বিহ্বলতা

৫.

বর্ষা এল না
*

তুমি বলছ বর্ষা এলো না
অথচ, বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে দ্যাখো -
কতগুলো মেঘ কীভাবে গোল
হয়ে বসেছে চায়ের বিকেলে।
চা কতো ঘন ! - সক্কর আর দুধের
অতিসম্পৃক্ত জীবন - মেঘের মত
গলে যাওয়া থেকে অবসর নিয়ে
জমাট কাদার মত বর্ষা হচ্ছে ওরা।
মাঝরাতে, তীক্ষ্ণ কিছু শিস
সহস্র নটিকার গভীরতায়
প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠে আসছে বৃষ্টির
মত। বরং তুমি, দু-একটা গান গাও
তেমন দিনে বলা অভিসারের মত
বর্ষার গানগুলো গাও। - বানভাসি মনে।
আর আমি দেখি কীভাবে ওই গলা
বেঁয়ে সুরমন্ডলি ঘাম হয়ে টিপ-টিপ
করে বার হচ্ছে - এক প্রবীন বর্ষার
মত। যে বর্ষার কোনো ভেজাবার
দায় নেই। নেই কোনো স্বছিদ্র ছাতাকে
ভাগ করে দেওয়ার উল্লাস।

বরং এস, দুজনেই বসে থাকি সেই বর্ষার জন্য
চায়ের বিকেল মুঠোয় নিয়ে
সম্পৃক্ত চিনি-দুধ মুঠোয় নিয়ে
আরো ঘন হই - এস
একটু একটু করে নির্লিপ্ত বর্ষার দিকে হাত বাড়াই।

৬.

স্ফিংক্স ও অচেনা অর্কিডেরা
*

‘ল’ অক্ষরে গাড়ির চাকা যেভাবে মাছি চলমান--

আমাকে কমপ্ল্যায়েন্স শেখাতে গিয়ে সিক্ত হয়ে
মাটি-গন্ধ বেমালুম নিম্নচাপ হয়ে পড়ছ

বৃষ্টি নেই বলে কাউকে আমি হিউমিড তোষামদ
আশ্রয় দিতে বলছি না

নৃসিংহ দেয়াল থেকে এন্ড্রোস্ফিংকস-নির্দয়-ভাস্কর্য তুই-তো দিলি

কঠিন হাত এনে হাতুড়ে সে বাঁচা
ফিরে আসছি পাথর ভাঙা গানে
স্বরলিপি প্রাচীন নেভালি কোরিতে

গ্রিফিন কিংবদন্তি নিয়ে নিস্তার পেতে পেতে
ফ্লাইট ল্যান্ড করছে

আলমারি খুলে দেখছি সোঁদা গন্ধ
ছাতা পড়ে আছে বোতাম

বছরভর বন্ধ ফ্ল্যাট থেকে অর্কিড গ্যালারি উঠে আসছে
সারি সারি ছবি ও ছক্কা প্রদর্শনী

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

অনুবাদ - Gloomy Sunday (আত্মহত্যার গান)

অনুকবিতা

অনুবাদঃ “আফরি” –“ the most beautiful one!”